আশিক মিজান
এ জীবন আল্লাহর এক বিশেষ রহমত। তাঁরই দয়ায় বেঁচে আছি আমরা। কারণে-অকারণে প্রতিদিন কত প্রাণ ঝরে যায়। আমিও তো হতে পারতাম তাদেরই একজন। কিন্তু না, আমার সে পরিণতি হয়নি। এ কি করুণা নয়? যে কখনো মরার চিন্তা করেনি সে-ও হারিয়ে গেল। নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে এলে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার সুযোগ নেই কারো। কী আজব পরীক্ষাগার! কার ডাক কখন আসবে কেউ বলতে পারে না। তবুও মানুষ বেমালুম ভুলে যায় সবকিছু। বাবার আগে ছেলে চলে যায়। ছেলের আগে বাবা। আবার মেয়ের দুখে কাঁদে মা।
তবুও মানুষ বেহুশ। দুনিয়ার মোহে অন্ধ। নিজের পরিণতি নিয়ে ভাবার সময় নেই। ভাবে না সে, আর দশটি জন্তু জানোয়ারের মতো আমি নিকৃষ্ট কোনো প্রাণী নই, যাকে বিনা হিসেবেই ছেড়ে দেয়া হবে। আমি তো আশরাফুল মাখলুকাত। আমার চিন্তা প্রসূত প্রতিটি কাজের হিসাব দিতে হবে। ছোট-বড়ো কিছুই বাদ পড়বে না।
একথা ভাবা উচিত, আমি মানুষ, নির্বুদ্ধিতার পরিচয় আমি দিতে পারি না। ভুলে যেতে পারি না আমার অস্তিত্বকে। আমার মহান ¯্রষ্টাকে। শয়তানের চ্যালেঞ্জে কাছে আমি যদি নিজেকে ধরা দেই, তার অশুভ পরিণতি আমাকেই ভোগ করতে হবে। শয়তান তো অবশ্যই সামনে-পেছন ও ডান-বাম থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। অশোভনীয়কে মানুষের কাছে শোভনীয় করে তুলবে। ভালোর প্রতি মানুষের অরুচি সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাবে। কিন্তু তার অনুসারী ব্যতীত সে মুমিন ও নেক্কার বান্দাকে পরাস্ত করতে পারবে না। তাই যারা আখিরাতকে বাদ দিয়ে দুনিয়াকে প্রধান্য দেবে তারাই নির্বোধ। এরাই ক্ষতিগ্রস্ত। শয়তান এদেরকে তার অনুগামী বানিয়ে নিয়েছে।
দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। এক অন্তহীন সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আখিরাতের একটি দিনের কাছে এই দুনিয়ার সময়টা নিতান্ত খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়, যা তার একটি দিনের কিছু অংশ মাত্র। এখানে আমরা একটা সকাল বা একটা বিকেলের মতো কিছুটা সময় কাটাচ্ছি। সুতরাং সেই অনন্তকালের কথা ভুলে গিয়ে এরই মাঝে মত্ত হওয়া চরম নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
তবে দুনিয়ার এই স্বল্প সময়টা প্রতিটি মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর উপর নির্ভর করে পরবর্তী জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা। এই পার্থিব জীবনটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মতো পরিচালিত করতে পারলে আখিরাতের সেই কল্যাণময় জীবনের সুসংবাদ অবশ্যই পাওয়া পাবে। যা প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের একান্ত কাম্য। যার প্রতিশ্রতি আল্লাহ তায়ালা তাঁদের দিয়েছেন।
সন্তান-সন্তুতি, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও যশ-খ্যাতির মোহে মানুষ আখিরাত থেকে গাফেল হয়ে যায়। ভুলে যায় আপন পালনকর্তাকে। এসব জিনিস তাদের কোনো কাজে আসবে না। কেয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনের অবস্থা এমন হবে, বাবা তার ছেলেকে চিনবে না, স্ত্রী তার স্বামী চিনবে না। চিন্তা কেবল একটিই, আজাবের এই ভয়াবহতা থেকে সে কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবে। একমাত্র মুমিনদের কোনো চিন্তা থাকবে না। থাকবে না কোনো ভয়। তারা এক মহা পুরস্কারের অপেক্ষা করবে।
মানুষ তার পরিবার-পরিজনের মুখে হাসি ফোটাতে অনেক সময় ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ ভুয়ে যায়। যদি মানুষ একবার ভালো-মন্দের কথা ভাবত, পরকালের কথা চিন্তা করত, সে এসব করতে পারতো না। তার ন্যায়বোধ ও পাপের প্রতি ঘৃণাই তাকে সত্যের পথে পরিচালিত করতো। প্রলুব্ধ আত্মা সে চিন্তা কখনো করে না। বিবেক তাকে বাধা দিলে সে অনুসরণ করেছে শয়তানের। কতই না ভালো হতো মানুষের জন্য, যদি সে তার সন্তান-সন্ততিদের নেক্কার ও পরহেযগার বান্দা হিসেবে কেয়ামতের ময়দানে পেয়ে যেত। যারা তাদের পিতামাতা নাজাতের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতো। দুনিয়ার জীবনে তাই ছেলে-মেয়েদের দ্বীনি শিক্ষা ও ইসলামি আদর্শে লালিত নেক্কার ও পরহেযগার মানুষ হিসেবে তৈরি সব বাবা-মারই দায়িত্ব। কোরআন হচ্ছে এক বিজ্ঞাময় গ্রন্থ, যা মানব মনের যাবতীয় চিন্তার খোরাক মেটায়। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার ও আন্তর্জাতিক পরিম-লের নীতি নির্ধারণী সব বিষয়েরই সমাধান রয়েছে এই গ্রন্থে।
সম্পদ মানুষ কত কাজেই ব্যয় করে। কেউ ভালো-মন্দের বিচার করে। আবার কেউ এসবের চিন্তাও না। সম্পদশালী ব্যক্তিরা যদি তাদের সম্পদে তাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবী মানুষদের যে হক রয়েছে তা আদায় করতো তাহলে বদলে যেতো আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো। সম্পদশালীদের উচিত সমাজের অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাদের সাহায্য সহযোগিতা করা। তাদের দু:খ-কষ্টকে ভাগাভাগি করে নেয়া। ইয়াতিমদের হক নষ্ট না-করে তাদের বিপদে এগিয়ে আসা। এটাই কোরআনের শিক্ষা।
ভালো কাজে সম্পদ ব্যয় করার সৌভাগ্য সবার হয় না। আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করেও যারা তার সেই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না, এই সম্পদ কেয়ামতের ময়দানে তাদের জন্য কঠিন মুসিবতের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কোনো উপকারে আসবে না এই সম্পদ। এই দুনিয়ায় যত সম্পদ রয়েছে এর সাথে আরো সমপরিমাণ সম্পদ যোগ করে এর বিনিময়েও যদি মানুষ সেদিন জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তি পেতে চায় তাতেও মুক্তি মিলবে না। সুতরাং সময় থাকতে সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। এই সম্পদই যেন হতে পারে আমাদের নাজাতের অছিলা।
ফেরাউন মতো অনেক বড় বড় খোদাদ্রোহীরাও শেষ মুহূর্তে ইমান আনতে চেয়েছে, কিন্তু সে ইমান গৃহীত হয়নি। আল্লাহর অবাধ্যতার পরিণামে তার পক্ষ থেকে আরোপিত শাস্তি একবার এসে গেলে তখন ইমান আনলে সে ইমান আর বান্দার কোনো কাজে আসবে না।
লেখক : সাহিত্যিক ও গবেষক