করোনাভাইরাস অতিমামীর কারণে গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। সেইসাথে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে উন্নয়নমূলক খাতগুলো। সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা। জীবন ও জীবিকার কথা চিন্তা করে অনেক দেশ অর্থনীতির নানা খাতকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনলেও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে শিক্ষাব্যবস্থাকে তারা ভিন্ন আঙ্গিকে বিবেচনা করছেন। যেহেতু এখনো করোনা নিয়ন্ত্রণে আসনি, সুতরাং নিশ্চিন্ত হয়ে বলা যাচ্ছে না সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যস্থার চিরচেনা রূপে কখন ফিরে আসতে পারবে। আমাদের পাশ্র্বর্তী দেশ ভারতে যে হারে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে তাতে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো অবকাশ নেই। হয়তো ক্রমেই পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারে। কারণ, সাধারণ মানুষ এখন আর স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কাই করছে না। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আগামী তিন অক্টোবর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। যদিও শিক্ষামন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর সহ কারিগরি ও মাদ্রাসা বোর্ডের সমন্বয়ে ৭০, ৫০ ও ৩০ দিনের একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে কোনটি যে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। যদি এই পরিস্থিতি ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে তাহলে সরকারকে এছাড়াও বিকল্প কিছু চিন্তা করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা মাথা ব্যথার বড় একটা কারণ ছিল। ইতোমধ্যে এই দুটো পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা এসেছে। পরীক্ষা দুটো বাতিল হওয়ায় ইতোমধ্যে পরীক্ষার বোঝা অনেকটা হালকা হয়েছে। তাই আশা করা যায়, আসন্ন এসএসসি পরীক্ষা ২০২০ যথাসময়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়তো সৃষ্টি হবে না। তবে অপেক্ষমান এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বার্ষিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান শ্রেণি রোল নম্বর ধরে পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন দেয়া এ সমস্যা সমাধানের একটি বিকল্প পথ হতে পারে। তবে আগাম সে ধরণের ঘোষণা কোনোভাবেই দেয়া ঠিক হবে না। তাহলে শিক্ষার্থীরা আর পাঠে মনোযোগী হবে না। বইপুস্তক ও টেবিল ছেড়ে উঠে পড়বে।
সবচে বেশি সমস্যা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে নিয়ে। পরিবেশ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না-আসা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। এই কোমলমতী শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সে ধরণের সুযোগ সুবিধা নেয়, যাতে তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। সবচে নাজুক অবস্থা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি, এরকম একটি পরিস্থিতিতে তাদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা মানে-ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া। যেখানে সচেতন মানুষই এখন স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাচ্ছে না। সেখানে কোমলমতি শিক্ষার্থী!
মার্চের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন। কারো আবার আগের তুলনায় আয়-উপার্জন কমেছে। অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। প্রাথমিক স্তর ও মাধ্যমিক স্তরের অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাসিক বেতনের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিফিন বাবদ আদায় করা হয়। যেহেতু মার্চের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ সুতরাং শিক্ষামন্ত্রণালয় চাইলে এপ্রিল থেতে যতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা আদায়ে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। এতে অনেক অভিভাবক উপকৃত হবেন। এরকম অন্যান্য বিষয়গুলোকে খতিয়ে দেখে মওকুফের আওতায় আনা যেতে পারে। এখানে এমপিওভুক্ত, নন এমপিওভুক্ত ও সরকারি বিদ্যালয়গুলোর সুযোগ-সুবিধার কথা আমলে নিয়ে অভিভাবকদের কল্যাণে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া প্রয়োজন।
ভর্তি নিয়ে বাংলাদেশে রমরমা বাণিজ্যের কথা কারোই অজানা নয়। বর্তমানে প্রথম শ্রেণিতে লটারির মাধ্যমে ভর্তি করা হলেও অনেক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক অর্ন্তভুক্ত থাকায় শিক্ষার্থীদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়। ফলে এই ভর্তিযুদ্ধ নিয়ে কোমলমতী শিক্ষার্থীরা শিকার এক নাজুক পরিস্থিতির। অভিভাবকের একাডেমিক নানা চাপে তারা এক স্নায়ুবিক দুর্বলতায় ভোগে। যা মেধা বিকাশের নামে এই সমস্ত কোমলমতী শিক্ষার্থীদের বিকারগ্রস্ত করে তোলে। তারাও শিক্ষার নামে এই ক্ষুদে শিশুটির উপর সৃষ্টি করেন এক ধরণের মানসিক চাপ। কাংঙ্খিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য অভিভাবকরা ছুটতে থাকেন এক শিক্ষকের কাছ থেকে অন্য শিক্ষকের কাছে। শিক্ষকরা এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করেন। করোনা এই দুঃসময়ে সংক্রামক ব্যাধির ভয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও আগামী শিক্ষাবর্ষে জন্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে দেশের অনেক জায়গায়ই কোচিং ক্লাস শুরু করে দিয়েছে। সরকার একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য পরীক্ষাপদ্ধতিতে ভর্তি না নিয়ে রেজাল্টের ভিত্তিতে ভর্তি নিচ্ছে। সুতরাং প্রাথমিকে নতুন ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি সিস্টেম চালুকরণ আর মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে পূরবর্তী ক্লাসের ফলাফলের উপর নির্ভর করে ভর্তি করা যেতে পারে। ফলে ভর্তি নিয়ে অভিভাবকদের যে বাড়তি টেনশন রয়েছে তার অনেকটাই কেটে যাবে। তবে ভর্তি প্রক্রিয়ার এ কাজগুলো হতে হবে অত্যন্ত স্বচ্ছ। এবং নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ভর্তি কমিটি গঠনের মাধ্যমে।